ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫
আপডেট : ২১ মে ২০২৫
একের পর এক ঋণ জালিয়াতি, লোপাট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, এবং দুর্নীতির কারণে দেশের ২০টি ব্যাংকে এক লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে।
এই অস্বাভাবিক ঋণ জালিয়াতি এবং মূলধন ঘাটতির পেছনে সরকারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একটি লুটেরা শ্রেণির উত্থানকেই দায়ী করছেন ব্যাংক ও অর্থনীতিবিদ মহল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে মূলধন ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১,৭১,৭৮৯ কোটি টাকা, যেখানে আগের প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই অঙ্ক ছিল ৫৩,২৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে ঘাটতি বেড়েছে ১,১৮,৫৩৪ কোটি টাকা।
যদিও কিছু ব্যাংকে মূলধন উদ্বৃত্ত থাকায় সম্মিলিতভাবে খাতটির মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১,১৭,৬৪৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে ডিসেম্বর শেষে মূলধন ঘাটতিতে থাকা বড় কয়েকটি ব্যাংকের তালিকা:
ব্যাংকের নাম | ঘাটতির পরিমাণ (কোটি টাকা) |
---|---|
জনতা ব্যাংক | ৫২,৮৯১ |
কৃষি ব্যাংক | ১৮,১৯৯ |
ইউনিয়ন ব্যাংক | ১৫,৬৯০ |
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী | ১৩,৯৯১ |
ইসলামী ব্যাংক | ১২,৮৮৫ |
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক | ১১,৭০৯ |
আইএফআইসি ব্যাংক | ৯,০২৯ |
ন্যাশনাল ব্যাংক | ৭,৭৯৯ |
রূপালী ব্যাংক | ৫,১৯২ |
পদ্মা ব্যাংক | ৪,৯৮৫ |
এছাড়া অগ্রণী, বেসিক, গ্লোবাল ইসলামী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী, স্ট্যান্ডার্ড, কমার্স, এবি, আল আরাফাহ ও বিদেশি হাবিব ব্যাংকের ঘাটতিও রয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা বেশি।
একই সময়ে ঋণ অবলোপন (write-off) হয়েছে ৮১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা, এবং পুনঃতফসিল হয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
এই তিনটি খাত মিলিয়ে ব্যাংক খাতের বিশাল অঙ্কের মূলধন হ্রাস পেয়েছে, যা বিদেশি বিনিয়োগ, এলসি (LC) খোলা, এবং সাধারণ গ্রাহকের আস্থার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
ব্যাংকিং খাতের মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত (CRAR) ডিসেম্বরে নেমে এসেছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে, যেখানে আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালায় এটি ন্যূনতম ১০% হওয়া আবশ্যক।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন:
“উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে অনেক ব্যাংক প্রভিশন রক্ষা করতে পারেনি। এর দায় অনেকটা আগের সরকারের অদক্ষ ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতির।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, মূলধন ঘাটতির কারণে এসব ব্যাংকের গ্রাহক আস্থা, ঋণ বিতরণ, লভ্যাংশ প্রদান ও আন্তর্জাতিক লেনদেন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অন্যদিকে, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন:
“গত ১৫ বছরে দেশে যে অর্থনৈতিক অরাজকতা তৈরি হয়েছে, তা অকল্পনীয়। লুটপাটের কারণে প্রায় ৩০টি ব্যাংক অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের পথে।”
তিনি জানান, অনেক ব্যাংক এখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনগুলো স্পষ্ট করে দেখাচ্ছে—ব্যাংক খাতে গত এক যুগে ঋণের নামে দুর্নীতি ও লুটপাটে অভাবনীয় আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের ছত্রছায়ায় চলায় এসব জবাবদিহির বাইরে থেকে গেছে। বর্তমান সরকার যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তবে দেশের আর্থিক খাত পুনরুদ্ধার করা দিনকে দিন আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
📎 তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন ও সংবাদ সংকলন